জিয়া হক: গতপরশু একজন কাছের ভাই জানালেন, “জিয়া, এক সপ্তাহ বাসায় কোনো বাজার নাই। হাতে টাকাও নাই। চাকরিটা হুট করে চলে গেল। গত ছয় মাসে অনেক ঋণ করেছি। বাসা ছেড়ে দিছি। বউ-বাচ্চা বাড়িতে পাঠিয়ে দিছি। আরো কত কী! বাসার খাট, আলমারি আর একটা প্লাস্টিকের বক্স কী করবো, কোথায় রাখবো? এসব তো আর কারো কাছে রাখা সম্ভব না।”
আরো অনেক কিছু লিখেছেন তিনি। শুনলাম কেবল। কিছু বলতে পারিনি। পরে ভাবছি বিষয়টা। কোনো কূল-কিনারা পাই না। এই কঠিন বিপদ শুধু একজনের না। অনেকের। অধিকাংশের।
০২. আজ সকালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। খেলা শেষ হয়েছে মাত্র। একজন বড় ভাই এসএসএস দিলেন। “ভাই, ছোট্ট মেয়েকে একটা সস্তা জামাও দিতে পারছি না। বেকার জীবন। সামান্য হেল্প করেন।”
ভাবলাম, ফেসবুক আইডি হ্যাকড হয়েছে কিনা। পরে জানলাম, তার জব চলে গেছে করোনার শুরুতেই। চরম অভাবে আছেন।
আমি নিজেই বেকার। একপয়সা ইনকাম নাই। এসব জেনেও আমাকে যারা দুঃখের কথা জানান। নিদারুণ কষ্টের কথা বলেন, তারা সিঙ্গাপুর বা কানাডার নাগরিক নন নিশ্চয়ই। আমার দেশেরই নাগরিক।
ছোট সন্তানের জন্য পটের দুধ কিনতে পারেন না। আধা কেজি চিনি কিনতে পারেন না। সন্ধ্যায়ও বাসায় ফিরতে চান না। কোন মুখে ফিরবেন? এই হতভাগা বাবাকে কিছু বলার ভাষা আমাদের অভিধানে আছে কি?
০৩. ক্ষুধার যন্ত্রণা আমরা সবাই বুঝি না। যিনি ক্ষুধাতুর তিনিই বোঝেন এর কতটা ব্যথা। কতটা বেদনা। অন্যরা উপলব্ধি করতে পারেন সামান্যই। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিই এমন। একজনের সুখ-দুখ অন্যকে অতটা ছুঁয়ে যায় না। যেতে পারে না। এজন্যই কবি বলেছেন, কী যাতনা বিষে/ বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে/ দংশেনে যারে।
আমার একজন শ্রদ্ধাভজন গল্প করতেন…
ধরো, তোমার পকেটে টাকা নাই। বাসা থেকে বের হলে, কোথাও যাবে। হালকা বৃষ্টি। হালকা রোদ। ছন্দদোলানো বৃষ্টির ফোঁটা তোমার ঝাঁকড়া চুলে পড়ছে। তোমার ডাগর চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছে। কী চমৎকার। “রোদ হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে, খেকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে” একটা ভাব। এই রোমান্টিক ওয়েদারও তখন তোমাকে ছুঁয়ে যাবে না। বরং তুমি বলবে, “ধুর, *লের বৃষ্টি। বের হলেই একটা জ্বালা। শালার কই যে যামু?”
আবার ধরো, পকেটে টাকা আছে। প্রচণ্ড রোদ। গা পুড়ে যাওয়া গরম। কোথাও একটু বাতাসও নেই। তুমি বের হয়ে বলবে, “বাহ, চমৎকার ওয়েদার। কী দারুণ রোদ! মিষ্টি একটা দুপুর গো, বেবি।”
পকেটে টাকার অভাবে রিকশায় উঠতে না পারলে কেমন লাগে? হাফ কিলো পথও কত দীর্ঘ তখন। কত কষ্ট, কত যন্ত্রণা তখন যে লাগে!
এসব প্রতিকুল অবস্থা কাটিয়ে কিছু মানুষ দাঁড়াতে পারলেও দৌড়াতে পারে না। অধিকাংশই ব্যর্থ হন। হোচট খান। পড়ে যান। একজন মধ্যবিত্ত/নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সারা জীবন শেষ করেও মধ্যবিত্তের বৃত্ত থেকে বেরুতে পারেন না। সৎপথে মধ্যবিত্তের বৃত্ত কিভাবে পেরোয়, আমার জানা নাই।
এই ছাইপাঁশ লিখতে লিখতেই মনে পড়লো মান্না দে’র গানের কলিটা, “কপালে সবার নাকি সুখ সয় না…”।
মনে পড়লো, রাস্তায় ক্ষেপে ওঠা চাচার কথা, “এই দ্যাশ আমাগো না। এই দ্যাশ ফুটবলদদের…”
লেখক : ছড়াশিল্পী ও কথাসাহিত্যিক