‘সব অধিকারের চেয়ে বড় হলো জীবনের অধিকার। বেঁচে থাকার অধিকার। আইনের চোখে প্রাণীর জীবনের অধিকার স্বীকৃতি পাবে, তেমন কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না।’ কথাটা বলেছেন ২০০৩ সালে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক জে. এম. কোয়েটজি।
প্রসঙ্গটা কুকুর নিয়ে। করোনার কারণে দীর্ঘ প্রায় অর্ধ বছর হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ। যে কারণে কুকুরদের চরম খাদ্য সংকট চলছে। কুকুরগুলো রাস্তাঘাটে, লোকালয়ে খাবারের জন্য আসছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ যখন পুরোদমে খুলবে, তখন এই কুকুর আর এভাবে দেখা যাবে না। এখন ঢাকা শহরে চলছে কুকুর নিধন অভিযান। অথচ কে না জানে, কুকুর মানুষের পরম বন্ধু। আবর্জনা পরিষ্কার তো রয়েছেই। ম্যানহোলে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর-ছুঁচোরা প্রকাশ্যে আসতে পারে না এই কুকুরের ভয়ে। আমাদের ঢাকা শহরেও ড্রেন ও ম্যানহোলে লাখ লাখ ইঁদুর রয়েছে। তাদের বংশ বিস্তার কুকুরের চাইতেও অনেক দ্রুত হয়। কুকুরগুলো যখন রাতের বেলা রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, তখন ইঁদুরগুলো কিন্তু বাইরে বেরুতে পারে না। অথচ ইঁদুর প্রায় প্লেগের মতো ১৫টি ভয়ানক রোগের বাহক। কুকুর থাকলে ভয়ে থাকে নগরীর রাতের চোর-ডাকাতরাও। এভাবে পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তাসহ প্রতিবেশ ব্যবস্থা ঠিক রেখে নগরবাসীর জন্য বড় অবদান রেখে যাচ্ছে কুকুর।
শুধু কুকুর কেনো? আমাদের আশপাশে যতো প্রাণী রয়েছে তারা যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবার একটু দেখা যাক- ব্যাঙ না থাকার কারণে, ফড়িং না থাকার কারণে, গাপ্পি মাছ না থাকার কারণে মশা নিয়ে আমাদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এ কারণে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় গত বছর অনেক মানুষ আমরা হারিয়েছি। ব্যাঙ যদি মশা খেয়ে কমিয়ে দিতে পারতো তাহলে পরিস্থিতি হয়তো অতটা খারাপ নাও হতে পারতো। আমাদের আসলে প্রকৃতিগতভাবেই একটা প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য আরেকটা প্রাণের ওপর নির্ভর থাকতে হয়। বাস্তুসংস্থানের এই নির্ভরতা থাকবেই। আমাদের আশপাশের প্রত্যেকটা প্রাণী, যেমন সাপ, ব্যাঙ সব কিছুরই আমাদের জীবনে গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু উপকারের বিপরীতে বরাবরই কুকুর, বিড়াল ও কাকের মতো প্রাণীদের সহ্য করতে হয় নানান নিপীড়ন। তবে, এটা বোঝা যায় যে এক শ্রেণীর মানুষ অপরাধ, অসততা ও পাশবিকতাকে যতোটা না ঘৃণা করে, এর চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা করে প্রভুভক্ত, সাহসী, বুদ্ধিমান ও সাহায্যকারী প্রাণী কুকুরকে।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নগর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে প্রায় ৩০ হাজার কুকুর। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিঘ্নিত হচ্ছে জনগণের চলাচল। কুকুর বিতর্কে অনেকে বলছেন, কুকুর প্রচুর আওয়াজ করে। রাতে ঘুমাতে দেয় না। কথাটা খুব মিথ্যা হয়তো নয়! পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শহরগুলোর মধ্যে একটা ঢাকা। ঢাকার সবচেয়ে নীরব এলাকাটাতেও গড়ে ৭০ থেকে ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে আপনি থাকেন। আবাসিক এলাকায় সহনীয় শব্দ দূষণের মাত্রা হওয়ার কথা আইন অনুযায়ী এর অর্ধেক। একপাল কুকুর একসঙ্গে আধঘণ্টা চিৎকার করলে ১০০ ডেসিবল শব্দ হয়। এবার বুঝুন কুকুর কত শব্দ দূষণ করে! মোটরবাইক চালকরা নাকি কুকুরের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন! ঢাকার রাস্তায় কয়জন মোটরবাইক চালক কুকুর বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন? প্রাণ হারিয়েছেন কয়জন- পরিসংখ্যান ঘেঁটে বের করা দরকার বৈকি।
এদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘কুকুর সরিয়ে নিলে রাজধানীর পরিবেশে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে, বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। একইসঙ্গে বড় ঝুঁকিতে পড়বে পুনর্বাসিত এলাকার মানুষ।’ কুকুরগুলো যে এলাকায় থাকে, সেসব এলাকার মানুষগুলোর সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজ করে। কুকুর কমিউনিটি বেসড হয়। কুকুর সাধারণত স্থানীয় কাউকে কামড় দেয় না। এদের অন্য কমিউনিটিতে নিয়ে গেলে সেখানকার কুকুরগুলো এদের গ্রহণ করবে না। যখন এই কুকুরগুলোকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন তারা সেখানকার কুকুরদের এবং স্থানীয়দের মানবে না। ফলে কুকুরে কুকুরে মারামারি হবে এবং কুকুর মানুষকেও কামড়াবে। ওরাও না খেয়ে মারা যাবে। ফলে কুকুর সরিয়ে নেওয়া বা মেরে ফেলা- এককথা।
খাবারের জন্য পশু সংহার করতেই হয়। হরিণ মেরে খাওয়ার জন্য বাঘকে যেমন নিষ্ঠুর বলা যায় না, তেমনি খাদ্য, আত্মরক্ষা বা সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনে বাঘ-হাতি-শূকর মারলে মানুষকেও নিষ্ঠুর বলা যায় না। স্বীকার করতেই হবে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন কর্মসূচি রয়েছে। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশেও কুকুর নিধন হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কুকুর নিধন হয়েছে। কিন্তু কুকুর কখনো বিলুপ্ত হয়নি কেনো? এর বড় কারণ হচ্ছে অপসারণের জন্য কুকুরগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় কিছু কুকুর পালিয়ে যায়। ওই কুকুরগুলো যদি পরের মৌসুমে বাচ্চা দেয়, তখন কুকুরের শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যায়। ফলাফল যেই সেই!
উন্নত দেশগুলোতে জঙ্গল থেকে একটা বাঘ, মোরগ, শিয়াল বা বন মোরগ বেরুলেও নির্ভয়ে পথ পাড়ি দিতে পারে। এজন্য চলন্ত গাড়ির সাড়ি পর্যন্ত থেমে যায়। বেওয়ারিশ কুকুর নেই বলে ওসব দেশে জলাতঙ্কের সমস্যাও নেই। বাংলাদেশে বাড়ছে জলাতঙ্কের ঝুঁকি। পরিসংখ্যানে মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর দুই হাজারের বেশি মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। চাট্টিখানি কথা! অন্য অনেক রোগের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগে মারা যাবার হার নিয়ে অবশ্যই উদ্বেগের কারণ রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পরে বাংলাদেশেই জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যুর হার বেশি। তাই ২০২২ সালের মধ্যে কুকুরের জলাতঙ্ক নির্মূল করতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জানা যায়, জলাতঙ্ক রোগ মোকাবিলার জন্য সারাদেশের ৭০ ভাগের ওপরে কুকুরকে এক রাউন্ড জলাতঙ্ক নির্মূল টিকা দেওয়া হয়েছে। খুব ভালো কথা। দরকার হলে আরো দেওয়া যেতে পারে। তবুও কুকুর মেরে অপসারণ কোনো সমাধান নয়। এজন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কুকুর বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প কার্যকর করতে পারে। নগর প্রতিবেশ ব্যবস্থার স্বার্থে সব সিটিতে কুকুরের বন্ধ্যাত্মকরণ ও জলাতঙ্কের টিকাদান কর্মসূচিতেই জোর দিতে হবে। নিষ্ঠুরভাবে কুকুর মেরে ফেলা আর নয়।
আরেকটি কথা, মানুষের হাতে এখন যন্ত্রণাবিহীন পদ্ধতিতে প্রাণীহত্যা করার উপায় রয়েছে। তাহলে সেটা কাজে না লাগিয়ে এখনও আমরা কেনো আদিম ও বর্বর পদ্ধতিতে কুকুর মারি? উত্তর একটাই। নিষ্ঠুরতাকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি। এক্ষেত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র তফাত নেই। প্রতিদিনের এই নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠুরতায় চুপ করে থেকে একটা ঘটনায় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তাই আসলে কোনো লাভ নেই। কারণ প্রশ্নটা এখানে নিপীড়ন নিয়ে। মানে, প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া নিয়ে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রবিশিষ্ট সমস্ত প্রাণীরই কম-বেশি যন্ত্রণার অনুভূতি রয়েছে। আর উন্নততর প্রাণী হিসেবে একমাত্র মানুষের অন্যান্য প্রাণীর যন্ত্রণাকে অনুভব করার ক্ষমতা ও দায়িত্ব রয়েছে। যাকে সহমর্মিতা বা অ্যামপ্যাথি বলে। এভাবে ভাবলে, নিষ্ঠুরতাও একটা বৈশিষ্ট্য। যা মানুষকে পশুর চেয়ে আলাদা করে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘যে কোনো প্রাণীকে আঘাত বা হত্যা করলে মানুষের অবচেতনে বিভিন্ন মাত্রার অপরাধ বোধ জন্ম নেয়। মশা-মাছির মতো ছোট্ট প্রাণীকে মারলে এই অনুভূতি সবচেয়ে কম, আর মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি।’
কিন্তু আমাদের আশেপাশে সারাক্ষণই দেখা যায়, কারণে-অকারণে মানুষ মানুষকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, মেরে ফেলছে। তাই মনে হয় ওটুকু অপরাধবোধ বুঝি জয় করা গেছে। বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসেবে রোজ আমরা নৃশংসতার পাঠ নিচ্ছি। চলচ্চিত্রের নায়করা পুলিশ সেজে হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজনকে নির্মম প্রহার করে। প্রতিশোধ নিতে নায়ক একের পর এক খুন করে। আমরা উপভোগ করি। বাস্তবেও সারাদেশে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমরাও চুপচাপ দেখেই চলেছি। কিন্তু অনেকেই জানি না যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্তের গায়ে হাত তোলার অধিকার পুলিশের নেই। তাই বলা যায়, নিষ্ঠুরতা দিনে দিনে আমাদের কাছে যেনো এক রকম স্বাভাবিক, অপরিহার্য, বৈধ, বীরত্বসূচক এমনকি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। এরপর বোধ হয় এ নিয়ে আর কথা চলে না।
তবুও কথা চালিয়ে যাওয়া কর্তব্য। জলাতঙ্ক রোধে শহর থেকে কুকুরগুলো না হয় তাড়ানো গেলো। কিন্তু মানুষরূপী কুকুরের কামড় জলাতঙ্কের চেয়েও ভয়াবহ। দুর্নীতি করে সরকারের সকল সফলতা, অর্জনকে ম্রিয়মাণ করে দিচ্ছে মানুষরূপী সেই কুকুরগুলো! নানান নামে বিভিন্ন সেক্টরে অনেক মানুষরূপী কুকুর বিরাজমান। এদের তাড়াবে কে? কুকুর সরানোর আগে দেশ থেকে, শহর থেকে মানুষরূপী কুকুরগুলো দূর করা প্রয়োজন।
লেখক: শেখ আনোয়ার (গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।